সুইটি মন্ডল: চৈত্রমাস পড়লেই আপনজনদের রাঙিয়ে দেওয়ার জন্য উচাটন হয়ে ওঠে আদিবাসী মানুষদের মন। শাল ফুলের মিষ্টি গন্ধ আর ঝরে পড়া পলাশের লালকে খোঁপায় গুঁজে গাঁয়ের মেয়েদের অপেক্ষা থাকে বাহা’র জন্য। এই পরব যে একে অপরকে মনেমনে রাঙিয়ে দেওয়ার। তার সঙ্গেই মহাপ্রভু মারাংবুরুর আশীর্বাদ ঘরের সুখশান্তি বয়ে আনার প্রার্থনা।
আদিবাসী মানুষদের এই বাহা পরবকে ঘিরে ৮-৮০ সবাই মেতে ওঠেন অপার আনন্দে। ৩ দিনের এই উৎসবের জন্য অপেক্ষা থাকে গোটা বছরটা। প্রতিবছর চৈত্রমাসে দোলের পর আদিবাসী সমাজে হয়ে থাকে এই বাহা পরব। ক্যালেন্ডারের দিন ধরে নির্দিষ্ট কোনো দিন নেই বাহার জন্য।
এই বাংলায় বছরভর অক্লান্ত পরিশ্রম করে খেটে খাওয়া মানুষরা নিজেদের সুযোগ সুবিধা মত দিন ঠিক করে নিয়ে বাহা পরবের আয়োজন করেন। গত সোমবার থেকে বাঁকুড়ার ইন্দাসের অঞ্চলের বহলালপুর আকুরেপাড় গ্রামের মানুষরা মেতে উঠলেন তাঁদের প্রিয় বাহা পরবে।
গ্রামের জাহের থানে আদিবাসীদের আরাধ্য দেবতা পাথরের শিলার মারাংবুরুর পুজো দিয়ে শুরু হয় বাহা পরব। সমাজের পুরোহিত ‘নাইকে বাবা’ মারাংবুরুর পুজো সেরে পুজোর প্রসাদ শাল গাছের নতুন ফুল ও আরও কিছু বাহারি ফুল নিয়ে গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে ঘুরে সেই প্রসাদ বিতরণ করেন।
বাড়ির মানুষরা নাইকে বাবার পা ধুইয়ে প্রণাম করে সেই প্রসাদ হাতে তুলে নেন। সংসারের মঙ্গল কামণার জন্য কিছু ফুল ঘরের ঠাকুর থানে রেখে বাকিটা বাড়ির মেয়েরা খোঁপায় গুঁজে নেন। পরম্পরার এই রীতি আজও অপরিবর্তিত।
গ্রামের সব বাড়ি ঘুরে নাইকে বাবা নিজের বাড়িতে ঢোকার পর শুরু হল দোল খেলা। তবে কথায় ‘দোল’ হলেও রঙের বাহুল্য নেই। সমাজের রীতি মেনে নিজেদের সম্পর্ক ধরে শুধু জলে ভিজিয়ে দেওয়া। সাবেক কাল থেকে অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতার কারণেই সম্ভবত জলে ভিজিয়ে কাল্পনিক রঙের উৎসবে মেতে ওঠেন এই মানুষরা।
উৎসবে আসা মানুষ বাবুলাল মুরমু বলেন “বাহা পরবের জন্য আমাদের সারাবছর অপেক্ষা থাকে। আমাদের সাধ্য মতো মূল পরবের দিন সবাই নতুন কাপড় পড়ে। ৩ দিনের পরবে প্রথম দিন ঘরবাড়ি পরিস্কার করে নিকিয়ে নেওয়া হয়। দ্বিতীয় দিন মারাংবুরুর পুজো হয়। আর শেষ দিনে নাচ-গানের সঙ্গে জল ঢালা খেলা। যাকে আপনারা হোলি খেলা বলেন সেটাই আমরা জল দিয়ে খেলি। এই পরব উপলক্ষে বাইরে থাকা আমাদের আত্মীয়স্বজনদের নিমন্ত্রণ করি, তাঁরা আসে এবং খুব মজা হয়। পরব শেষ হয়ে গেলেই মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়।” বাহা পরবের শেষ দিনে জল ঢালা খেলার পর ধামসা-মাদলের তালে মেয়েরা কোমড় বেঁধে নাচগানে মেতে উঠলেন।